গাজার রাস্তায় হামাস বিরোধী গর্জন: শান্তির ডাক, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নতুন অধ্যায়?
Special Report (Somanath Gope) : গাজার রাস্তায় এক বিরল দৃশ্য, দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, বিধ্বস্ত জনপদ আর সেই বিপর্যয়ের মাঝেই হামাসের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রামের ঢাকে কাঠি পড়লো এবার গাজার সাধারণ মানুষের হাতে। শত শত ফিলিস্তিনি রাস্তায় উঠে দাঁড়িয়েছে, তাদের সমবেত কণ্ঠে ঐক্যবদ্ধ ডাক— “হামাস বিদায়! আমরা শান্তি চাই!”। বহু বছর ধরে যারা নিজেদের জাতির মুক্তির সৈনিক হিসেবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছিল সেই গাজার শাসক গোষ্ঠীর হামাসের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের স্বর সাধারণ ফিলিস্তিনিদের।
গত 7 অক্টোবরের ইজরায়েল পুনরায় আক্রমণের পর প্রথমবারের মতো গাজার রাস্তায় এত ব্যাপক আকারের হামাস বিরোধী বিক্ষোভের দৃশ্য দেখা গেল। বেইত লাহিয়ার রাস্তা থেকে শুরু করে শহরের নানা কোণে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে শান্তির স্লোগান ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ বা পোস্টারের লিখেছে শান্তির আহ্বান, আবার কেউ নিজের মুখের মাধ্যমে উচ্চস্বরে দাবী জানাচ্ছে—যুদ্ধের অবসান চাই, বিধ্বস্ত রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কাঠামোর বিনাশের মধ্যেই, এই মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ। এই প্রতিবাদ শুধু একটি মুহূর্তে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ক্রোধ নয়, বরং দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশার প্রতিচ্ছবি, যা দিকে দিকে এই বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।
হামাসের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভে মানুষের ক্ষোভের পাশাপাশি এক গভীর হতাশারও সুর বাজছে। বছরের পর বছর যুদ্ধ বিধ্বস্ত হয়ে অবরুদ্ধ থাকা, খাদ্য সংকট, ধ্বংসের পরিধি প্রতিনিয়ত ইসরায়েলের টানা বিমান হামলায় বাড়ছে, তার মধ্যেও সাধারণ ফিলিস্তিনিরা হামাসের চাপে চুপচাপ থাকতে বাধ্য ছিল, কিন্তু গাজার রাস্তায় উঠে আসা এই প্রতিবাদের পেছনে নিহিত রয়েছে মানুষের সেই দীর্ঘদিনের কষ্ট, হতাশা এবং জীবনের প্রতি নতুন করে আশার জাগরণ এটা স্পষ্ট।
হামাসের প্রতিক্রিয়া তেমনই স্পষ্ট, তাদের অমানবিক মুখোশধারী সশস্ত্র বাহিনী দ্রুত রাস্তায় নামতে শুরু করে ও বন্দুক আর লাঠি হাতে হঠাৎ বিক্ষোভকারীদের মুখে ভয় ছড়িয়ে দেয়। তবে এই ভয় সত্ত্বেও, ক্ষুধার্ত, আহত ও শোকার্ত জনগণ আর শান্ত না থেকে বাঁচার থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি উচ্চস্বরে শোনা যায় যে তারা শুধু অস্ত্রের নয়, শান্তির ভাষাতেও কথা বলতে চায়। তাদের ক্রন্দন হয়তো আজ অস্থায়ী, কিন্তু এতে নিহিত রয়েছে নতুন এক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা, যেখানে শাসনের বদলে জনমতের জোর গড়ে উঠবে।
গাজার এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলেও নানা রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি যে বদলে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট। গাজার জনগণের এই বিদ্রোহ হয়তো হামাসের শাসনের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করবে, নতুন কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তবে অন্যদিকে, ইসরায়েল ও কূটনৈতিক ভাবে গাজার এই অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারে। যদি ইসরায়েল গাজার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তবে এই প্রতিবাদ দ্রুত দমন হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও, তা জনগণের দীর্ঘদিনের আশা ও চাহিদাকে নিঃশেষ করবে না।
এই ঘটনার পেছনে নিহিত রয়েছে এক গভীর মানবিক সত্য—যুদ্ধের ক্লান্তি, দমননীতি আর নৃশংসতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধের এক অদম্য ইচ্ছা। গাজার রাস্তায় উঠে আসা এই প্রতিবাদ শুধু সাময়িক বিদ্রোহ নয়, এটি মানুষের আত্মসম্মান, স্বাধীনতা ও শান্তির প্রতি এক অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে স্পষ্ট যে গাজার মানুষ আর নীরব থাকতে পারবে না। তাদের ক্রন্দন যেন ভবিষ্যতের নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করে, যেখানে যুদ্ধের বদলে শান্তির গান বেজে উঠবে।
কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রশ্ন— এই বিদ্রোহের আগুন কি একদিন সত্যিই গাজার শাসন ব্যবস্থাকে বদলে দেবে, নাকি এটি কেবল সাময়িক ক্লান্তি আর হতাশার প্রকাশ? সময়ই দেখাবে, তবে একটাই ব্যাপার নিশ্চিত—গাজার মানুষ শুধু অস্ত্রের নয়, শান্তির ভাষাতেও কথা বলতে শুরু করেছে, আর সেই ভাষা মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ চিহ্নিত করবে।